ইসলাম শিল্প, সাহিত্য, জ্ঞানবিজ্ঞান ও মানবকল্যাণের ধর্ম। এসব ক্ষেত্রে মুসলমানদের গৌরবময় ইতিহাস ও ঐতিহ্য রয়েছে। ইসলামে জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চার প্রতি অপরিসীম গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। কুরআন মাজিদের প্রথম বাণীতেই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে (ইকরা) "পড়-জ্ঞানার্জন কর"। কুরআন মাজিদ হলো জ্ঞানবিজ্ঞানের ভাণ্ডার, তাই একে 'আল হাকীম'- বিজ্ঞানময় কুরআন বলা হয়।
পবিত্র কুরআন মাজিদে বলা হয়েছে-
অর্থ: "যাকে হিকমাত (বিজ্ঞান) দান করা হয়েছে, তাকে প্রভূত কল্যাণ দান করা হয়েছে।" (সুরা বাকারা: ২৬৯)
ইসলামে জ্ঞানান্বেষণ করা নরনারী নির্বিশেষে সবার জন্য বাধ্যতামূলক। তাই, মানুষ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ইসলাম চর্চা করবে এবং কুরআন ও হাদিস নিয়ে গবেষণা করবে। যেসব বিষয় কুরআন মাজিদে বলা হয়েছে, অথচ এখনও পর্যন্ত মানুষ আবিষ্কার করতে পারেনি সে সম্পর্কে গঠনমূলক গবেষণা করবে। বস্তুত কুরআন ও হাদিস জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা বিস্তারের মূল উৎস। তাই কুরআন ও হাদিস গবেষণার জন্য গবেষণাকেন্দ্র থাকা প্রয়োজন। মূলত যা কিছু আবিষ্কার হয়েছে এবং হচ্ছে- এসবই ইসলামের অবদান।
শিক্ষা ক্ষেত্রে মুসলমানদের অবদান
মানবসভ্যতা ও সংস্কৃতির যথাযথ উন্মেষ ও বিকাশে মুসলিম জাতির অবদান অবিস্মরণীয়। ইসলাম জ্ঞান অর্জন ও শিক্ষা গ্রহণকে ফরজ করে দিয়ে শিক্ষা ও জ্ঞাননির্ভর যে ধারার সূচনা করেছে তারই ধারাবাহিকতায় মুসলিম মনীষীরা গবেষণায় আত্মনিয়ােগ করেছেন। তাঁদের অনুসন্ধিৎসা ও গবেষণা জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষার নতুন নতুন দিগন্ত উন্মােচিত করেছে। যে জন্য আধুনিক বিজ্ঞান কেবল চমকপ্রদ আবিষ্কার ও কালােত্তীর্ণ তত্ত্বের জন্যই মুসলিমদের কাছে ঋণী নয়,বরং আজকের এই অত্যাআধুনিক বিজ্ঞান তার অস্তিত্বের জন্যও মুসলিম মনীষীদের কাছে চিরঋণী।
হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর অবদান
বিশ্বনবি হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা (স) অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন না হলেও তিনি ছিলেন মহাজ্ঞানী। তিনি কারাে কাছ থেকে প্রাতিষ্ঠানিক কোনাে শিক্ষা গ্রহণ করেননি। তাঁর একমাত্র শিক্ষক হলেন মহান আল্লাহ তায়ালা। ওহি পাঠানোর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা রাসুল (স) কে সব বিষয়ের জ্ঞানদান করেছেন। সে জন্য রাসুলুল্লাহ (স) শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিলেন। নবুয়ত লাভের তিন বছরের মধ্যেই তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্তা নেন। এ সময়ে মক্কার পরিবেশ পুরােপুরি ইসলামের বিরুদ্ধে ছিল। মুসলিমদের কোনাে রকমের সামাজিক বা রাজনৈতিক প্রভাব ছিল না। এই সময় সাধারণত গরিব শ্রেণির লােকেরা ইসলাম গ্রহণ করেছিল। তাই মুসলিমদের অর্থনৈতিক অবস্থাও তেমন ভালাে ছিল না।
চারিদিকে এতসব সমস্যা থাকা সত্ত্বেও এরকম একটি বৈরী পরিবেশে রাসুলুল্লাহ (স) 'দারুল আরকাম' নামে একটি মাদ্রাসা বানান। পবিত্র মক্কা নগরীর সাফা পাহাড়ের উপরে হযরত আরকাম (রা) এর বাড়ির মধ্যে মাদ্রাসাটি বানান। দারুল আরকামের প্রথম শিক্ষক ছিলেন রাসুল (স)। তিনি সেখানে মুসলিমদের প্রয়ােজনীয় হুকুম-আহকাম শেখাতেন। রাসুলুল্লাহ (স)-এর নিজের বাসগৃহটিও বিদ্যালয়ের রূপ লাভ করেছিল। সবার জন্য এবং সবসময় এ বাড়ির দরজা উন্মুক্ত ছিল। প্রিয় নবি হযরত মুহাম্মাদ (স)-এর সাথে উম্মুল মুমিনীনগণও শিক্ষাদানে আত্মনিয়ােগ করেছিলেন। যে জন্য রাসুলের (স) ইন্তেকালের পর হযরত আয়েশা, হাফসা, উম্মে সালমা প্রমুখ নবিপত্নীর উদ্যোগে নবিজীর ঘর নারীদের জন্য শিক্ষাকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল।
বদর যুদ্ধে বন্দি মুশরিকদের মুক্তিপণ হিসেবে রাসুলুল্লাহ (স) শিক্ষাবিস্তারের ক্ষেত্রে একটি অভিনব উদ্যোগ নেন। তিনি প্রতিজন শিক্ষিত বন্দিকে তিনজন মুসলমানকে জ্ঞানদান করার শর্তে মুক্তি দেন। মসজিদে নববির নির্মাণ কাজ শেষ হলে শিক্ষাবিস্তারে রাসুলুল্লাহ (স) অবিস্মরণীয় অবদান রাখেন। তিনি মসজিদের বারান্দায় একটি আবাসিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে শিক্ষার্থীরা নিয়মিত অবস্থান করে নবিজীর (সা) থেকে জ্ঞান অর্জনে আত্মনিয়ােগ করতেন। এ বিদ্যালয়টি 'সুফফা' এবং এর শিক্ষার্থীরা 'আহলি সুফফা' নামে পরিচিত। মসজিদে নববিতে মহানবি (স) নিজে বিভিন্ন শিক্ষার আসর পরিচালনা করতেন। হযরত মুহাম্মাদ (স) শিক্ষাগ্রহণ করতে এবং শিক্ষাপ্রদান করতে ব্যাপক উৎসাহ দিতেন। এর ফলে মহানবি (স) একটি অশিক্ষিত জাতিকে পৃথীবির সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষিত জাতিতে পরিণত করতে পেরেছিলেন।
খোলাফায়ে রাশেদার অবদান
হযরত মুহাম্মাদ (স) এর প্রতিষ্ঠিত শিক্ষার বুনিয়াদ খােলাফায়ে রাশেদার আমলে ব্যাপক ও বিস্তৃত রূপ লাভ করে। খােলাফায়ে রাশেদার চার সদস্য যথাক্রমে হযরত আবু বকর (রা), উমর (রা), উসমান (রা) ও আলী (রা) শিক্ষাবিস্তারে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখেন। তাদের সবাই মসজিদে নববিকে প্রধান শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করেন। পাশাপাশি খিলাফতের অধীন সব মসজিদকে শিক্ষালয়ে পরিণত করেন।
হযরত আবু বকর (রা)-এর খিলাফতকালে পবিত্র কুরআন মাজিদের গ্রন্থাবদ্ধ সংকলন সম্পন্ন হয়। হযরত উসমান (রা) কুরআন শরিফ গ্রন্থাবদ্ধ সংকলন এর পূর্ণাঙ্গ শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেন, যা শিক্ষাবিস্তারে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
হযরত উমর (রা) প্রথম শিক্ষাবিস্তারের প্রাতিষ্ঠানিক ধারা প্রবর্তন করেন । তিনি খিলাফতের বিভিন্ন এলাকায় মক্তব ও আনেক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এসব প্রতিষ্ঠানে বায়তুল মাল থেকে বেতনভুক্ত শিক্ষক নিয়ােগ করেন। যাযাবর বেদুইনদের শিক্ষিত করার জন্যও হযরত ওমর (রা) শিক্ষক নিয়ােগ করেন এবং কোন ব্যক্তি কমপক্ষে কুরআন তিলাওয়াত করতে না পারলে তার জন্য শাস্তির বিধান প্রবর্তন করেন।
হযরত উসমান ও আলী (রা) এ ব্যবস্থার প্রভৃত উন্নতি সাধন করেন। আলী (রা) তার অসামান্য পাণ্ডিত্যের জন্য রাসুল (স) এর কাছ থেকে 'জ্ঞানের দ্বার' উপাধি লাভ করেন। তাঁদের সদিচ্ছায় মুসলিম খিলাফতে শিক্ষাদান ও গ্রহণে বিপুল গতি সঞ্চার হয়।
উমাইয়া খলিফাদের অবদান
শিক্ষাবিস্তারে উমাইয়া খলিফাদের ভূমিকাও কম নয়। উমাইয়া খলিফা উমর বিন আব্দুল আযীয রাষ্টরীয়ভাবে হাদিস সংকলনের উদ্যোগ নেন। এ সময়ে দামেস্ক, কুফা, বসরা, মক্কা, মদিনা প্রভৃতি অঞ্চলে কুরআন-হাদিসের অসংখ্য শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। সরকারি পৃষ্ঠপােষকতার মাধ্যমে জ্ঞান এবং বিজ্ঞান চর্চার বেশ কিছু খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানও গড়েে উঠেছিল।
উমাইয়া খলিফা দ্বিতীয় হাকাম ৭৯৮ খ্রিটাব্দে স্পেনের রাজধানী কর্ডোভাতে প্রতিষ্ঠা করেন 'কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয়'। আজও পর্যন্ত এ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাবিস্তারে ব্যাপক অবদান রাখছে। উমাইয়া খলিফাদের প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ পৃষ্ঠপােষকতায় মুসলিম মনীষীদের মধ্যে জ্যোতির্বিদ্যা, ভূগােল, চিকিৎসা, গণিত, নৌচালনা প্রভৃতি বিভিন্ন শাস্ত্রীয়জ্ঞান আলােচনার সূত্রপাত হয়। এ সময়ে ইসলামি ফিকহশাস্ত্র এর ওপর বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন ধারার কাজ শুরু করা হয় যা পরে সুসংঘবদ্ধ রূপলাভ করেছিল।
আব্বাসীয় খলিফাদের অবদান
আব্বাসীয় খলিফাগণ রাজ্য জয়ের চেয়ে জ্ঞানার্জন ও শিক্ষা বিস্তারে বেশি মনােযোগ দেন। ফলে শিক্ষা ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক অধ্যায় সূচিত হয়। আর মুসলিম জাতির শিক্ষাবিস্তারের স্বর্ণযুগ নির্মাতা হলাে আব্বাসীয় রাজবংশ। আব্বাসীয় খলিফা আল-মনসুর প্রথম শিক্ষাবিস্তারে খিলাফতকে সম্পৃক্ত করেন। তার সময়ে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে গ্রিক ও সংস্কৃত পুস্তকের আরবি অনুবাদ শুরু হয়। পরবর্তী খলিফা হারুন অর রশীদ এ ধারার পূর্ণতা সাধন করেন।
এই ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য খলিফা আল মামুনের নাম। তিনি বাগদাদে 'বায়তুল হিকমাহ' নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তােলেন। এটি বিভিন্ন বিভাগে বিন্যস্ত ছিল। বায়তুল হিকমাহ গড়ে উঠেছিল পাঠাগার, গবেষণা, অনুবাদ, মানমন্দির ও শিক্ষাদান বিভাগ নিয়ে। এটি ছিল মূলত একটি পূর্ণাঙ্গ আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়।
আব্বাসীয় খলিফাগণ শিক্ষাবিস্তারের কাজ সুলভ ও সহজ করার জন্য বাগদাদে কাগজের কল স্থাপন করেন। তারা রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে বেতনভুক্ত অধ্যাপক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়ােগ করেন। সরকারি বেতনভুক্ত হলেও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল। শিক্ষাকে সর্বজনীন করে তােলার জন্য আব্বাসীয় খলিফাগণই প্রথম মসজিদভিত্তিক পাঠাগার ব্যবস্থা গড় তােলেন। ১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দে মঙ্গোল শাসক হালাকু খান এর হাতে ধ্বংসের আগপর্যন্ত বাগদাদ ছিল শিক্ষাবিস্তার ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার রাজধানী।
ইউরােপে শিক্ষাবিস্তারে মুসলমানদের অবদান
৭১২ খ্রিষ্টাব্দে মুসলমানদের স্পেন বিজয়ের মাধ্যমে ইউরােপে ইসলামের প্রচার শুরু হয়। পরবর্তীতে এটিই সারা বিশ্বের শিক্ষা, শিল্প-সভ্যতা ও সংস্কৃতির রাজধানী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও ইতালি থেকে আগত শিক্ষার্থীরা কর্ডোভা, সেভিল, টলেডাে, জেইন ও মালাগার উচ্চশিক্ষায়তনগুলােতে ভিড় জমাতে থাকে। স্পেনের কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয় মিশরের আল আজহার ও ইরাকের নিজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চাইতেও উন্নত ছিল।
কুরআন, আরবি ব্যাকরণ ও কবিতা পাঠের মধ্য দিয়ে স্পেনে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হতাে। উচ্চশিক্ষার মধ্যে তাফসির, ধর্মশাস্ত্র, দর্শন, আরবি-ব্যাকরণ, অভিধানশাস্ত্র, ইতিহাস, ভূগােল, জ্যোতির্বিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা ও চিকিৎসাবিদ্যা প্রভৃতি শিক্ষা দেওয়া হতাে। স্পেনের শিক্ষা এবং সংস্কৃতির বিপুল উন্নতি সেখানকার শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানীদের ঐতিহাসিক কার্যকলাপ এবং বিশ্বখ্যাত গ্রন্থাগারের বইয়ের সংগ্রহ দেখে বােঝা যায়।
সাহিত্যে মুসলমানদের অবদান
সাহিত্য মানবসভ্যতা ও সমাজের দর্পণ। এটি সমাজের কথা বলে। সাহিত্য সভ্যতার ইতিহাস বহন করে। যে কোনো জাতির সাহিত্য তাদের সমাজ ও সভ্যতার বাস্তব চিত্র তুলে ধরে। একজন মানুষের মনস্তাত্ত্বিক উন্নয়নে সাহিত্য অসামান্য অবদান রাখে।
মুসলিম সমাজে সাহিত্য
মুসলিম সমাজেও সাহিত্য সমাদৃত। ইসলামপূর্ব আরব এর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। ইসলাম প্রতিষ্ঠার আগে আরবের সাহিত্যে বিশৃঙ্খল ও কুরুচিপূর্ণ মানসিকতার বিকাশ ঘটেছে। ইসলামের আবির্ভাবের সূচনালগ্ন থেকে সাহিত্যের ধারা পরিবর্তন হয়ে যায়। সাহিত্যের ক্ষেত্রে সূচনা হয় রুচিশীল নবধারা, যার মােকাবিলায় তাদের নগ্ন সাহিত্যের মুখ থুবড়ে পড়ে। সাহিত্য তার মাধুর্যতা ফিরে পায়। সাহিত্যের উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হচ্ছে মহাগ্রন্থ পবিত্র আল কোরআন মাজিদ।
আরবের সবচেয়ে বিশুদ্ধতম ভাষার অধিকারী
আরবের সবচেয়ে বিশুদ্ধতম ভাষার অধিকারী ছিলেন প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। এজন্য যুগে যুগে মুসলিম সমাজের মধ্যে সাহিত্যচর্চার শুরু হয় ইসলামের সূচনাকাল থেকেই। মুসলমান কবি-সাহিত্যিকরা কলমের আঁচড়ের মাধ্যমে পুষ্টি জুগিয়েছেন পাঠকের মনে। হৃদয়কে করেছেন পরিতৃপ্ত। স্রষ্টাপ্রেম, মানবপ্রেম, ন্যায়নীতি, উত্তম আদর্শ ও শিষ্টাচার, সত্য ও ন্যায়ের প্রতি আহ্বানে পরিপূর্ণ ইসলামী সাহিত্য সমাজ গঠনে অনন্য অবদান রাখে।সাহিত্যে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর অবদান
বিশ্ব নবী আল্লাহ তা'য়ালার প্রিয় নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আরবের মধ্যে সবচেয়ে বিশুদ্ধতম ভাষার অধিকারী ছিলেন। বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর হাদিস সাহিত্যে মুসলিম মনীষীদের পদচারণা সুগম করে তােলে। ব্যক্তিগতভাবে রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) শিষ্ট ও সুরুচিসম্পন্ন সাহিত্যের সমঝদার ছিলেন। তিনি এ জাতীয় সাহিত্য চর্চাকে উৎসাহিত করেন। তাঁর উৎসাহ ও পৃষ্ঠপােষকতায় সাহাবী হযরত লাবীদ (রাদিয়াল্লাহু আনহু ), হযরত হাসসান বিন সাবিত (রাদিয়াল্লাহু আনহু), হযরত কাব বিন যুহাইর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) প্রমুখ সাহাবি কবি অমর কাব্য রচনা করে প্রথম সার্থক ইসলামি সাহিত্যের সূচনা করেন।
চার খলিফা, উমাইয়া ও আব্বাসীয়দের অবদান
খােলাফায়ে রাশিদার স্বর্ণযুগে খলিফাদের সহযােগিতায় ইসলামি সাহিত্যের গতি অব্যাহত থাকে। চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) নিজে "দিওয়ান-ই-আলী" ও "নাহজুল বালাগা" নামে শিক্ষামূলক কাব্য সম্ভার উপহার দেন। আব্বাসী খিলাফতকালের সময় আব্বাসীয় খলিফা আল-মনসুর এর প্রচেষ্টায় প্রাচীন আরবি কবিতাসমূহ গ্রন্থাবদ্ধ হয়। খলিফা হারুন অর রশীদ এর সময়ে বিশ্ববিখ্যাত আরব্য রূপকথা 'আলিফ লায়লা ওয়া লায়লা' রচিত হয়।
সাহিত্যে পরবর্তীযুগের মনীষীদের অবদান
মুসলিম কবি সাহিত্যিকদের অবদানে সর্বাধিক সমৃদ্ধ সাহিত্য ভাণ্ডার গড়ে ওঠে উর্দু ও ফার্সি ভাষায়। আমীর খসরু, নূর কুতুবুল আলম, শেখ জাহিদ কাব্য রচনায় নতুন ধারার সূচনা করেন। হযরত মাওলানা জালালুদ্দীন রুমী, শেখ সাদী, জামী নিযামী, হাফিয, ফেরদৌসী প্রমুখ সাহিত্যে সুফি ভাবধারা ও ইতিহাসমুখিতা সংযুক্ত করেন। 'দাস্তানে আমীর হামযা' 'মসনবি' "শাহনামা' গুলিস্তা, বুস্তা প্রভৃতি কালজয়ী ফার্সি কাব্যগ্রন্থ। আমাদের মহাকবি আল্লামা ইকবাল,মির্যা গালিব, কবি হালি প্রমুখ উর্দু সাহিত্যের উন্নতি ও অগ্রগতির চেষ্টা করেন। আল্লামা ইকবালের "শিকওয়া ওয়া জওয়াবে শিকওয়া" চিন্তাশীল সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন।
বাংলা সাহিত্যে মুসলিম মনীষীদের অবদান
সেই দীর্ঘ প্রাচীন সময় থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত বাঙালি মুসলমান সমাজের মানুষ ও মানবতার জাগরণের ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখার মাধ্যমে দেশের কল্যাণ ও শিক্ষার প্রসারে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। বাঙালি মুসলমান সমাজ কখনোই তাদের ধর্মচর্চার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাকে অন্তরায় হিসেবে বিবেচনায় নেয়নি। বরং বাঙ্গালী মুসলিম কবি, লেখক, গবেষক ও সাহিত্য স্রষ্টাদের অবদানে আজ আমাদের বাংলা ভাষা এবং বাংলা-সাহিত্য এতটা সমৃদ্ধ হয়েছে। মুসলিমদের প্রত্যক্ষ অবদানেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিকশিত হয়েছে। শাহ মুহাম্মদ সগীর, দৌলত উজির, সৈয়দ সুলতান, আলাওল, কায়কোবাদ, শেখ ফয়জুল্লাহ প্রমুখ বাংলা সাহিত্যের উদ্ভব ও বিকাশে অসামান্য অবদান রাখেন। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, সৈয়দ ইসমাইল হােসেন সিরাজী, ফররুখ আহমাদ, মীর মোশাররফ হােসেন, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, গােলাম মােস্তফা, আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, শেখ আবদুর রহিম, মােজাম্মেল হক, আল মাহমুদ প্রমুখ বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদান রেখে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন।
দর্শনশাস্ত্রে মুসলমানদের অবদান
জীবন ও জগতের প্রকৃত সত্য উদঘাটনের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টার নাম দর্শন। কুরআন মাজিদ থেকে এ দর্শন উৎপত্তি লাভ করে। আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর রাসুল (স)-এর উৎসাহে মুসলিম চিন্তাবিদগণ মুক্ত ও নির্মোহ দর্শন আলােচনায় আত্মনিয়ােগ করেন। ফলে খারেজি, শিয়া, মুরজিয়া, জাবারিয়া, কাদারিয়া, মুতাজিলা, আশআরী, সুফি প্রভৃতি ধর্মতাত্ত্বিক-দার্শনিক মতবাদসমূহ জন্মলাভ করে। এ সব মতবাদ বিশ্বদর্শনকে, দর্শনশাস্ত্রকে দারুণ প্রভাবিত ও সমৃদ্ধ করে। মুসলিম দার্শনিকদের মধ্যে অন্যতম হলেন আলী বিন আবু তালিব (রা), হাসান বসরী, ওয়াসিল বিন আতা, আবুল হুদায়েল আল্লাফ, আল-জুবাই, যামাকশারী, আবুল হাসান আল-আশআরী, আল-বাকিল্লানী, জুওয়াইনী, শাহরাস্তানী, ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী, আল-কিন্দি, আল-ফারাবী, ইবনে সীনা, ইমাম গাযযালী, ইবনে রুশদ, ইবনে খালদুন ও আল্লামা ইকবাল প্রমুখ।
আল কিন্দি (৮১৩-৮৭৩ খ্রিস্টাব্দ)
আবু ইউসুফ ইয়াকুব বিন ইসহাক আল কিন্দি তার যুগের শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ ও সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক ছিলেন। তিনি বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রিক, পারসিক ও অন্যান্য সংস্কৃতি নিয়ে পড়াশােনা করেন। অধ্যয়ন শেষে আল-কিন্দি গ্রিক দর্শন অনুবাদের কাজ শুরু করেন। তিনি আব্বাসীয় খলিফাদের অনুবাদ কর্মকর্তা হিসেবে 'এরিস্টটলের ধর্মতত্ত্ব' (Theology of Aristotle) আরবিতে অনুবাদ করেন। তাকে 'আরব জাতির দার্শনিক' বলা হয়। তিনি 'ফালাসিফা গােষ্ঠীর প্রবর্তক। দর্শনশাস্ত্রে তার শ্রেষ্ঠ অবদান On the Intellect,On the five Essences, Analytica, Categories, Apology of Aristotle, Almagistia of Ptolemy,The Elements of Euclid, History of Aristotle প্রভৃতি। দর্শন, জ্যোতির্বিজ্ঞান, রসায়ন, চক্ষুবিজ্ঞান ও সংগীতের ওপর আল-কিন্দির ২৬১ খানা গ্রন্থের কথা জানা যায়।
আল-ফারাবি (৮৭০-৯৫০ খ্রিষ্টাব্দ)
আবু নসর মুহাম্মাদ আল ফারাবী ছিলেন আল-কিন্দি প্রতিষ্ঠিত ফালাসিফা গােষ্ঠীর শ্রেষ্ঠতম মৌলিক চিন্তাবিদ। তিনি দর্শনচর্চা ও জ্ঞানসাধনায় জীবন উৎসর্গ করেন। যুক্তিবিদ্যা ও দর্শনে তার অসাধারণ দখল ছিল। তিনি এরিস্টটলের দর্শনের সাথে প্লেটোর দর্শনের সমন্বয় ঘটান এবং এরিস্টটলের ওপর প্রায় অর্ধশত গ্রন্থ রচনা করেন। যুক্তিবিদ্যা ও এরিস্টটলের দর্শনে বিশেষ দক্ষতার জন্য তাকে 'দ্বিতীয় এরিস্টটল' এবং 'আল-মুআল্লিমুস সানি বা দ্বিতীয় শিক্ষক বলা হয়। দর্শনে আল-ফারাবীর শ্রেষ্ঠ অবদান তাঁর শতাধিক মহামূল্যবান গ্রন্থ। এর প্রায় অর্ধেকই গ্রিক দার্শনিকদের রচনার টীকা ও সমালােচনা গ্রন্থ। তাঁর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থগুলোর মধ্যে ইবারা, মাঘালিত, জাদল, খাতাবা, মাকুলাত, বুরহান, কিয়াস, আল-শের, তাফসির, দি ইসাগােপ অব পরফিরি অন্যতম।
ইবনে সিনা (৯৮০-১০৩৭ খ্রিষ্টাব্দ)
চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক হিসেবে বিশ্ববিখ্যাত হলেও আবু আলী আল হুসাইন ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে সিনা ছিলেন বিশ্বমানের দার্শনিক। তিনি ধর্ম ও দর্শনকে আলাদা করে দেখান এবং প্রমাণ করেন দর্শন কেবল তাত্ত্বিক আলােচনা নয় বরং এটির প্রায়ােগিক মূল্যও আছে। আল-কিন্দি ও আল-ফারাবী ইসলামি শিক্ষার সাথে এরিস্টটলীয় দর্শনের সমন্বয় সাধনের যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন ইবনে সিনা তাতে পূর্ণতা দান করেন। তিনি এ দর্শনের সাথে নব্য প্লেটোবাদী দর্শনের সমন্বয়সাধন করে এক নতুন দার্শনিক ধারার সূচনা করেন। কিতাব 'আশ-শিফা' তার সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। এ গ্রন্থটি মোট চারটি ভাগে বিভক্ত। যথা: যুক্তিবিদ্যা (Logic), প্রাকৃতিক বিজ্ঞান (Natural Sciences), গণিত (Mathematics) এবং অধিবিদ্যা (Metaphysics)। এ গ্রন্থ রচনার ক্ষেত্রে ইবনে সিনা প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল ও মুসলিম দার্শনিক আল কিন্দি, আল ফারাবি ও আল-বিরুনিকে অনুসরণ করেন। এছাড়াও তার দর্শনগ্রন্থের মধ্যে উয়ূন আল হিকমাহ, দানেশ নামা, কিতাবুল ইনসাফা, হিকমাতি মাশারিফিয়া প্রভৃতির কথা উল্লেখ করা যায়।
ইমাম-গাজ্জালি (১০৫৮-১১১১ খ্রিষ্টাব্দ)
মুসলিম দর্শনে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক হলেন ইমাম আবু হামিদ মুহাম্মদ বিন আলী আল-গাযযালি। মুসলিম ধর্মতত্ব ও দর্শনে এবং সুফিবাদে তার অবিস্মরণীয় অবদান তাকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে। তিনি ধর্মান্ধতার অপসারণ করেন। আল্লাহভীতির পুনঃপ্রবর্তন করেন। তার চেষ্টায় সুফিবাদ ইসলামের অভিন্ন মতবাদ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। দর্শনে আল-গাযযালীর শ্রেষ্ঠ অবদান তাঁর অমর গ্রন্থরাজি। তিনি দুশতাধিক গ্রন্থ রচনা করেন। এগুলোর মধ্যে ইহইয়া উল উলুম আদুদীন', আল-মানকাব মিনাদ দালাল, তুহফাতুল ফালাসিফা, কিমিআয়ে সা'আদাত, মাকাসিদুল ফালাসিফা, মিনহাজুল আবেদীন প্রভৃতি অন্যতম।
ইবনে রুশদ (১১২৬-১১৯৮ খ্রিষ্টাব্দ)
অনারব মুসলিম দার্শনিকদের মধ্যে আবু ওয়ালিদ মুহাম্মাদ বিন আহমদ ইবনে রুশদ অন্যতম। ইবনে রুশদ এরিস্টটলীয় দর্শনের মূলত্ত্ব খুঁজে বের করার প্রয়াস পান এবং এ দর্শনের সাথে ইসলামি চিন্তার সামঞ্জস্য ও সমন্বয়বিধান করেন। তিনি প্রত্যাদেশ ও প্রজ্ঞা উভয়কেই সত্য আখ্যা দেন এবং ধর্ম ও দর্শনকে অভিন্ন বিষয় মনে করেন। তাহাফাতুত তাহাফা, কিতাবুল ফালাসিফা, ফাসলুল মাকালী ফি মুওয়াফিকাতিল হিকমাহ ওয়াশ শরিয়া, কিতাবুল কাশাফান, কিতাবু ফি হারকাত আলআফ প্রভৃতি তার কালােত্তীর্ণ দর্শনগ্রন্থ।
ইবনে খালদুন (১৩৩২-১৪০৬ খ্রিষ্টাব্দ)
ওয়ালিউদ্দীন আব্দুর রহমান ইবনে খালদুন মুসলিম বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজত্ত্ববিদ-ঐতিহাসিক দার্শনিক। তার জ্ঞানদর্শন, ইতিহাসদর্শন, শিক্ষা ও রাষ্ট্রদর্শন তাকে কালােক্তীর্ণ মুসলিম চিন্তাবিদে পরিণত করেছে। তিনি ইতিহাসকে জ্ঞানের অন্যতম উৎস প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে এবং তা একটি বিজ্ঞান ও দর্শনের অংশ। ইবনে খালদুন শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রয়ােগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পােষণ করেন। 'আল-মুকাদ্দিমা' তার রচিত বিখ্যাত বই। তার এই গ্রন্থের ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল সপ্তম শতকের উসমানীয় খলিফাদের ওপর।
আল্লামা ইকবাল (১৮৭৭-১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দ)
আল্লামা ড. মুহাম্মদ ইকবাল এক বিস্ময়কর দার্শনিক প্রতিভা। বিগত সহস্রাব্দের শ্রেষ্ঠতম চিন্তাবিদ তিনি। একই সাথে তিনি ছিলেন সাধক, দার্শনিক, কবি, ভাষাশিল্পী, শিল্পসমালােচক, আইনবিদ, রাজনীতিক ও শিক্ষাবিদ। বিগত দিনের সকল বিখ্যাত চিন্তাবিদদের অনুসৃত পথের বাইরে তার পরিক্রমা একটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র মৌলিক পথে। তিনি দেখিয়েছেন, সংসার থেকে পালিয়ে নয় বরং জীবনসংগ্রামেই আত্মা মােহমুক্ত হয়। ইকবাল মানবব্যক্তিত্ব বিশ্বাস করেন এবং এর চরমউ ন্নতিবিধানকেই চূড়ান্ত সাফল্য মনে করেন। এ চিন্তাধারার আলােকে তিনি তার বিখ্যাত খুদী তত্ত্ব' পেশ করেন। আসরার ই-খুদী, পায়াম-ই-মাশরিক, জাবিদ নামা, রুমুজ-ই-বেখুদী, যবুর-ই-আযম প্রভৃতি তার শ্রেষ্ঠ দর্শন কাব্য। বস্তুত এ সহস্রাব্দে তার মতাে করে আর কেউ চিন্তাজগতে এমন ব্যাপক আলোড়ন তুলতে পারেননি।
প্রযুক্তিতে মুসলমানদের অবদান
প্রযুক্তি (Technology) বলতে বিজ্ঞানের ব্যাবহারিক দিককে বােঝায়। অক্সফোর্ড ডিকশনারি- তে প্রযুক্তি- র সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, The application of scientific knowledge for practical purposes. প্রযুক্তি বলতে কিছু প্রায়ােগিক কৌশলকে বােঝায়, যার সাহায্যে মানুষ প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত উপাদানকে নিজের প্রয়ােজনে সহজে ও দক্ষতার সাথে কাজে লাগাতে পারে। যেমন- আগে মানুষ যােগাযােগের জন্য উচু পাহাড়, সৃষ্ট প্রতিধ্বনি। আগুনের ধোঁয়া প্রভৃতি ব্যবহার করত। কিন্তু যােগাযােগ প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে মানুষ এখন কম্পিউটার, রেডিও, টেলিভিশন, মােবাইল, স্যাটেলাইট প্রভৃতি ব্যবহার করছে।
প্রযুক্তির বিভিন্ন ক্ষেত্র
যােগাযােগ ছাড়াও প্রযুক্তির আরও নানাবিধ ক্ষেত্র রয়েছে। মানবজীবনের প্রায় প্রতিটি দিকের সাথেই প্রযুক্তি জড়িত। একেকটি প্রযুক্তির সংযােজন ও উন্নয়ন মানবজীবনের একেকটি দিককে করেছে বিশেষভাবে প্রভাবিত। প্রযুক্তির কয়েকটি উল্লেখযােগ্য ক্ষেত্র হলাে: জৈব প্রযুক্তি, মহাকাশ প্রযুক্তি, যােগাযােগ প্রযুক্তি, চিকিৎসা প্রযুক্তি, তথ্য প্রযুক্তি, নৌ প্রযুক্তি, ন্যানাে প্রযুক্তি, রাসায়নিক প্রযুক্তি, কৃষি প্রযুক্তি, নির্মাণ প্রযুক্তি প্রভৃতি।
প্রযুক্তির ধারা
প্রযুক্তির ধারা অত্যন্ত গতিশীল ও নিত্য পরিবর্তনশীল। সময়ের সাথে মানবসভ্যতার যেমন বিবর্তন ঘটেছে তেমনি মানুষ নিত্যদিনের নানাবিধ সমস্যার সমাধানে প্রযুক্তিরও উন্নয়ন করেছে। প্রযুক্তির উন্নয়নের মাধ্যমে দৈনন্দিন কাজকে করেছে সহজ থেকে সহজতর। মহান আল্লাহ তায়ালা ১৮ হাজার মাখলুকাত সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্যে মানুষই সর্বশ্রেষ্ঠ। বাকি সব মাখলুকাত মানুষের প্রয়ােজনে ব্যবহারের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। বিশ্বের সব সৃষ্টিই সরাসরি মানুষের প্রয়োজন পূরণে কাজে লাগানাে সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার কিছু পরিবর্তন,পরিবর্ধন ও সংযাজন। এজন্যই মানুষ প্রযুক্তির সাহায্য নেয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বিভিন্নভাবে মানুষকে প্রযুক্তির প্রতি উৎসাহিত করেছেন। পৃথিবীর প্রথম মানব হযরত আদম (আ) কে সৃষ্টির পরেই আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতের বিভিন্ন বিষয়ের নাম ও সেগুলাের ব্যবহার শিখিয়েছেন। মহাগ্রন্থ আল কুরআন হলাে বিশ্বের সব জ্ঞানের উৎস। এমন কোনো বিষয় নেই যার ইঙ্গিত কুরআনে নেই।
প্রযুক্তি সম্পর্কে কুরআনের বিভিন্ন আয়াত
- প্রযুক্তির উন্নয়নের লক্ষ্যে আল্লাহ তায়ালা বিভিন্নভাবে ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন। যেমন: খাদ্য সংরক্ষণে প্রযুক্তির উৎকর্ষের প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে সুরা ইউসুফের ৪৭-৪৮ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন- 'তােমরা ক্রমাগত সাত বছর উত্তমরুপে ফসল ফলাতে থাকবে। অতঃপর ফসল তােলার সময় এলে তােমরা যে পরিমাণ ফসল তুলতে চাও তার মধ্য থেকে সামান্য অংশ তােমাদের খাবারের জন্য রাখবে, তা বাদ দিয়ে বাকি অংশ শীষ সমেত রেখে দেবে। এরপর সাতটি কঠিন (খরার) বছর আসবে, এ দিনের জন্য তােমরা যা রেখেছিলে, তা খেয়ে যাবে, কিন্তু অল্প পরিমাণ ব্যতীত যা তােমরা (বীজের জন্য) তুলে রাখবে।'
এছাড়াও মানুষের জীবনকে আরও সহজ, সুন্দর, সমৃদ্ধ ও প্রাণবন্ত করার জন্য আল্লাহ কুরআন ও তাঁর নবির মাধ্যমে বিভিন্নভাবে আধুনিক থেকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির নির্দেশনা দিয়েছেন। নিচে কয়েকটি ইঙ্গিতপূর্ণ বস্তব্য তুলে ধরা হলাে:
- পােশাক প্রযুক্তির প্রতি ইঞ্জগিত দিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন: 'জান্নাতে তাদের স্বর্ণ-কঙ্কণে অলংকৃত করা হবে এবং তারা পাতলা ও মােটা রেশমের সবুজ কাপড় পরিধান করবে (সুরা কাহফ: ৩১)।
- গৃহস্থালির বিভিন্ন ব্যবহার্য দ্রব্যাদি তৈরির প্রযুক্তি উৎকর্ষের জন্য পশুর চামড়া ব্যবহারে ইঙ্গিত দিয়ে আল্লাহ বলেছেন: চতুষ্পদ জন্তুর চামড়া দিয়ে তােমাদের জন্য তাঁবুর ব্যবস্থা করেছেন। তােমরা এগুলােকে সফরকালে ও অবস্থানকালে পাও। ছাগল এর পশম, উট এর বাবরিচুল এবং ভেড়ার পশম দিয়ে কত ব্যবহারের সামগ্রী ও আসবাবপত্র তৈরি করেছেন একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত (সুরা নাহল: ৮০)।
- যাতায়াতের সুবিধার জন্য ও মানব পদচারণা বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে আল্লাহ নৌ-প্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা দিয়ে সুরা হুদ এর ৩৭-৩৮ নং আয়াতে হযরত নূহ (আ) এর কাহিনি বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ বলেন:আর তুমি একটি নৌকা তৈরি কর আমার চোখের সামনে ও আমার ওহী অনুসারে ' ( সুরা হুদ: ৩৭)
- বাতাসকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শুন্যে ভেসে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যে যাওয়া যায় এই ধারণা আমরা পাই হযরত সুলায়মান (আ) এর ঘটনা থেকে, যা থেকে মানুষ 'এরােস্পেস' এর প্রযুক্তিগত ইঙ্গিত পায়।
- লােহা ও তামার ব্যবহার প্রযুক্তির উন্নয়নকে করেছে ত্বরান়িত। এ সম্পর্কে ইঙ্গিত রয়েছে আল কুরআনের সুরা সাবা-এর ১০-১৩ নং আয়াতে। আল্লাহ বলেন, (আমি তাকে বলেছিলাম, সে বিগলিত লােহা দিয়ে) তুমি পূর্ণ মাপের বর্ম তৈরি করো এবং সেগুলাের কড়াসমূহ যথাযথভাবে সংযুক্ত করাে (সুরা সাবা: ১১)
প্রযুক্তিতে মুসলিম মনীষীদের অবদান
কুরআন ও হাদিসের এরূপ ইঙ্গিতপূর্ণ বিভিন্ন বক্তব্যে উৎসাহিত হয়ে এবং গবেষণা করেই মুসলিম মনীষীগণ প্রযুক্তির বিভিন্ন শাখায় নিজ নিজ অবদান রেখে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তাদের অবদান নিচে তুলে ধরা হলাে :
- কাগজ আবিষ্কারের আগে সাহাবিগণ ওহি সংরক্ষণের জন্য ব্যবহার করতেন গাছের পাতা, বাকল, পাথর প্রভৃতি। ৭০৪ খ্রি, সমরখন্দ মুসলমানদের আয়ত্তে আসলে চীনের কাগজ শিল্পে প্রযুক্তির প্রাথমিক স্তরের ব্যাপক উন্নয়ন করেন মুসলমানগণ।
- মুসলিম বিজ্ঞানী আল জাজারী (১১৩৬-১২০৬ খ্রি.) ঘূর্ণায়মান হাতল আবিষ্কারের মাধ্যমে পানি উত্তোলনের যন্র তৈরি করেন, যা হাইড্রো পাওয়ার প্রযুক্তিতে চলত। মধ্যযুগে মুসলিম বিশ্বের প্রায় সর্বত্রই তার তৈরি এ যন্ত্রের ব্যবহার হতাে। তিনি পানিচালিত জলঘড়িও তৈরি করেছিলেন।
- স্পেনের বিখ্যাত মুসলিম বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী আব্বাস ইবনে ফারনাস (৮১০-৮৭৫ খ্রি.) সর্বপ্রথম সূক্ষ ক্রোনােমিটার ও চশমা আবিষ্কার করেন।
- মিশরের মুসলিম বিজ্ঞানী ইবনে ইউনুস (৯৫०-৯৯৬) ঘড়িতে পেন্ডুলামের সফল ব্যবহার করেন।
- ইবনে সিনা (চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক) তার মায়ার আল আকল এ কপিকল ভারােক্তোেলক, স্ক্র, গোঁজ, চরকি এর ব্যবহার সম্পর্কে প্রথম আলােকপাত করেন।
- মহাবিজ্ঞানী যাকারিয়া আল রাযি নবম শতাব্দীতে কেরােসিন উৎপাদন পদ্ধতি আবিষ্কার করে তৈরি করেন নাফাতাহ্ বা কেরােসিনের বাতি। তিনি কৃত্রিম উপায়ে বরফ তৈরির পদ্ধতিও উদ্ভাবন করেন।
- চিকিৎসা প্রযুক্তিতে ইবনে সিনাকেই জনকের আসন দেওয়া হয়। আল রাযি, হাসান ইবনে হায়সাম প্রমুখ মনীষীগণ শরীরের বাড়তি গােশত কাটা, হাড় কাটা, দাঁত তােলা, ক্ষত সেলাই করা প্রভৃতি কৌশলী যন্ত্রপাতি আবিষ্কারের মাধ্যমে চিকিৎসা প্রযুক্তিতে আধুনিকতার ছোঁয়া দিয়েছিলেন।
- হাসান ইবনে হায়সামের তৈরি করা 'ম্যাগনিফাইং গ্লাস' গবেষণার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল । এটি বর্তমানেও গবেষণার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে।
- জ্যোতির্বিজ্ঞানেও মুসলমানরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। মুসলমানদের মধ্যে ইব্রাহীম আল ফাজারী হলেন প্রথম প্রযুক্তিবিদ, যিনি সূর্য ও নক্ষত্রের উচ্চতা নির্ণয়ের সহায়ক যন্ত্র অ্যাস্ট্রলেইব (Astrolabe) নির্মাণ করেন। এছাড়াও একাদশ শতাব্দীর দিকে সূর্যের উচ্চতা নির্ণয়ের নিমিত্তে মুসলিম বিজ্ঞানী আবু মােহাম্মদ আল খুজাব্দী তৈরি করেন 'আস সুদ আল ফাখরী এবং 'আল আলা-আস সামিল' নামে দুটি যন্ত্র। দ্বাদশ শতাব্দীর দিকে জনাব নাসিরউদ্দিন তুসী একটি 'মানমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। পঞ্চদশ শতাব্দীতে এসে "ইকুয়েটেরিয়াম' নামে গ্রহসমূহের অবস্থান নির্ণয়ে সহায়ক একটি যন্ত্র তৈরি করেন মুসলিম জ্যোতির্বিদ জামশিদ গিয়াসউদ্দিন আল কামী।
- মুসলমান পরমাণু বিজ্ঞানীদের মধ্যে ভারতের ড. এ. পি. জে আব্দুল কালাম ও পাকিস্তানের ড. আব্দুল কাদির খানের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়।
এছাড়াও পােশাক প্রযুক্তির উন্নয়ন মুসলমানদের হাত ধরেই হয়েছিল। কুফাতে তৈরি মেয়েদের ওড়না কুফিয়া বাগদাদের 'বাদাচিন', মাওসিলের, 'মসলিন' মিসরের ফুসতাতের কাপড় 'ফাসতিযান' প্রভূতি কাপড় তৈরির উন্নত প্রযুক্তির স্বাক্ষর বহন করে। বর্তমানেও ইরানের কার্পেট ও সিরামিক শিল্প বিখ্যাত। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ বাংলাদেশ বর্তমানে তৈরি পােশাক রপ্তানিতে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ দেশ।
ওপরের আলােচনা থেকে বলা যায়, মানুষ তার প্রয়োজন পূরণে প্রযুক্তির উন্নয়নে সর্বদাই সচেষ্ট ছিল। আর এ সব উন্নয়নে মুসলমানদের ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। মুসলমানগণই ছিলেন এই উন্নয়নের পথ প্রদর্শক। বর্তমানের এই আধুনিক প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ, যার শুরুটা হয়েছিল মুসলমানদের হাতেই।
পদার্থবিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান
জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মতাে পদার্থবিজ্ঞানেও মুসলিম মনীষীদের গুরত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। যেসব মুসলিম মনীষী পদার্থবিজ্ঞানে অসামান্য অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে হাসান ইবনে হায়সাম, আবু রাইহান আল বিরুনি, আবুল ফাতাহ আল খাজনি, মুহাম্মাদ আবদুস সালাম ও জামাল নজরুল ইসলামের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।
হাসান ইবনে হাইসাম
হাসান ইবনে হাইসাম (৯৬৫-১০৩৯ খ্রি.) শ্রেষ্ঠ মুসলিম পদার্থবিজ্ঞানী। তিনি স্পেনের কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাশাস্ত্র ও পদার্থবিদ্যা শিক্ষাগ্রহণ করেন। ১০০৫ খ্রিষ্টাব্দে ফাতেমীয় শাসক আল হাকিম কায়রােতে 'দারুল হিকমা' নামে একটি বিজ্ঞান গবেষণাগার এবং একটি মানমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। ইবনে হায়সামকে এ গবেষনাগার ও মানমন্দিরের অধ্যক্ষ নিয়ােগ করা হয়। এ দায়িত্ব পালনকালে তিনি গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষায় পদার্থবিদ্যার গ্রন্থগুলাে অনুবাদ করেন। এর পাশাপাশি আলােকবিজ্ঞানের ওপর ব্যাপক গবেষণা চালিয়ে নিজেও কয়েকখানা মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেন। 'কিতাবুল মানাযির' তার দৃষ্টিবিজ্ঞান বিষয়ক কালোত্তীর্ণ মৌলিক গ্রন্থ। এটি ছিল মধ্যযুগে আলোকবিজ্ঞানের ওপর একমাত্র গ্রন্ধ। ইবনে হায়সাম আলাের প্রতিফলন ও প্রতিসরণ বিষয়ে গ্রিকদের ভুল ধারণা খণ্ডন করেন। গ্রিকরা মনে করত, চোখ থেকে বের হওয়া আলাে বাহ্য পদার্থকে দৃষ্টিগােচর করায়। ইবনে হায়সাম দেখান, বাহ্য পদার্থ থেকেই আমাদের চোলে আলােক রশ্মি প্রতিফলিত হয় এবং এভাবেই আমরা দর্শনযােগ্য বিষয়সমূহ দেখতে পাই। ইবনে হাইসাম 'ম্যাগনিফাইং গ্লাস' আবিষ্কার করেন। তিনি গতিবিজ্ঞান নিয়েও কাজ করেন। নিজ গ্রন্থে তিনি বায়ুমণ্ডলের ওজন, চাপ এবং মাধ্যাকর্ষণ শক্তি বিষয়ে আলােচনা করেন। তিনি প্রমাণ করেন যে, পদার্থের ওপর বায়ুমণ্ডলের চাপের তারতম্যের জন্য পদার্থের ওজনেও তারতম্য হয়। স্যার আইজাক নিউটনকে (১৬৪২-১৭২৭ খ্রি.) মাধ্যাকর্ষণ শক্তির আবিষ্কারক মনে করা হলেও ইবনে হায়সাম এ তত্ত্বের মূল প্রবক্তা।
আবু রায়হান আল বিরুনি
মুসলিম মনীষী আবু রাইহান আল বিরুনি (৯৭৩-১০৪৮ খ্রি.) পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একটি পরিচিত নাম। তিনি শতাধিক বিভিন্ন ধরনের ধাতু ও পাথর সংগ্রহ করে সেগুলাে নিয়ে গবেষণা পরিচালনা করেন। তিনি প্রায় ১৮ ধরনের মূল্যবান ধাতু ও পাথরের ঘনত্ব নির্ণয় করেন। স্থিতিবিদ্যা (Statics) ও গতিবিদ্যাকে (Dynamics) একীভূত করে বলবিদ্যা (Mechanics) নামক গবেষণার নতুন ক্ষেত্র প্রবর্তন করেন।
মুহাম্মাদ আবদুস সালাম
মুসলিম পদার্থবিজ্ঞানী মুহাম্মদ আবদুস সালাম ১৯২৬ সালের ২৯ জানুয়ারি বর্তমান পাকিস্তানের পাঞ্জাবে জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষা-দীক্ষা ও ধর্মের ক্ষেত্রে তার বিশেষ পারিবারিক ঐতিহ্য ছিল। আবদুস সালাম মাত্র ১৪ বছর বয়সে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর অর্জনের রেকর্ড করায় পুরাে শহরের মানুষ তাকে স্বাগত জানায়। তিনি ১৯৪৯ সালে যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানে বি.এ (সম্মান) ডিগ্রি লাভ করেন। আবদুস সালাম প্রাক-ডক্টরেট পর্যায়ে পদার্থবিজ্ঞানে অসাধারণ অবদান রাখায় ১৯৫০ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'স্মিথ পূরস্কার' লাভ করেন। তিনি ১৯৫১ সালে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ওপর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল 'কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিকসের' মৌলিক কাজ (Fundamental work in quantum electrodynamics) যার জন্য তিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশেষ খ্যাতি লাভ করেন। তিনি তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান ও প্রায়ােগিক গণিতের উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখেন। কর্মজীবনের শুরুতে আবদুস সালাম পাকিস্তানের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। পরবর্তিতে ১৯৫৭ সাল থেকে তিনি লন্ডনের ইমপেরিয়াল কলেজের তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন। আবদুস সালাম সেখানে প্রায় চল্লিশ বছর যাবৎ পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক কণাতত্ত্ব নিয়ে গবেষগা করেন। এছাড়াও পদার্থবিজ্ঞানে তার উল্লেখযোেগ্য অবদান হলাে পাটি-সালাম মডেল, ম্যাগনেটিক ফোটন, ভেক্টর মেসন, গ্র্যান্ড ইউনিফাইড তত্ত্ব ও ইলেকট্রোউইক ইউনিফিকেশন তত্ত্ব (EIectroweak Unification Theory) প্রভৃতি। ইলকট্রোউইক ইউনিফিকেশন তত্ত্বের জন্য তিনি ১৯৭৯ সালে প্রথম ও একমাত্র মুসলিম মনীষী হিসেবে পদার্থবিজ্ঞানে নােবেল পুরস্কার লাভ করেন। উন্নয়নশীল দেশগুলাের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নে আবদুস সালামের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তিনি ১৯৯৬ সালের ২১ নভেম্বর যুক্তরাজ্যে মৃত্যুবরণ করেন।
জামাল নজরুল ইসলাম
বিখ্যাত গণিতবিদ ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম ১৯৩৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের বর্তমান ঝিনাইদহ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬৪ সালে যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রায়ােগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ওপর পিএইচডি ডিগ্রি এবং ১৯৮২ সালে ডক্টর অব সায়েন্স' ডিগ্রি অর্জন করেন। মহাবিশ্বের উৎপতি, গঠন, বিবর্তন ও পরিণতি সম্পর্কে তিনি মৌলিক গবেষণা করেন। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন ও মুহাম্মাদ আবদুস সালামের গবেষণার সূত্র ধরে তিনি তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কর্মজীবনে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। প্রায়ােগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণার লক্ষ্যে তিনি সেখানে একটি গবেষণাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও পরিণতি সম্পর্কে লেখা তার দুটি বিখ্যাত গ্রস্থ হলাে 'The Ultimate Fate of The Universe' (১৯৮৩) এবং An Introduction to Mathematical Cosmology' (১৯৯২)। তাঁর রচিত বই জাপানি, ফরাসি ও পর্তুগিজসহ বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয় এবং অক্সফোর্ড,ক্যামব্রিজসহ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানাে হয়। প্রায়ােগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে তার অসামান্য অবদানের জন্য তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বহু পুরস্কার লাভ করেন। তিনি ২০০১ সালে একুশে পদক লাভ করেন। বাংলাদেশের এ মহান মুসলিম মনীষী ২০১৩ সালের ১৬ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন।
ভূগোল শাস্ত্রে মুসলমানদের অবদান
অজানাকে জানা, কেবলা নির্ধারণ, ইসলাম প্রচার ও ব্যবসায়-বাণিজ্যসহ নানা কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের জন্য মুসলমানদের ভূগােলবিষয়ক জ্ঞানার্জনের প্রয়ােজনীয়তা দেখা দেয়। এ প্রয়ােজন পূরণের লক্ষ্যে মুসলিম ভূগােলবিদরাই সর্বপ্রথম বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভূতত্ত্ব নিয়ে আলােচনা করেন এবং একে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যতম শাখা হিসেবে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাদের ভূগােলবিষয়ক জ্ঞানের উৎস ছিল পর্যবেক্ষণ, অভিজ্ঞতা ও কুরআন মাজিদ।
ভূগােলশাস্ত্রের মুসলিম মনীষীদের নাম
মুসলিম মনীষীদের মধ্যে আল মুকাদ্দাসি, আল মাসউদি, ইয়াকুত ইবনে আবদুল্লাহ আল হামাবি, আল ইদ্রিস, মুসা আল-খাওয়ারিযমি, আল বিরুনি ও ইবনে খালদুন প্রমুখ ভূগোলশাস্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। নিচে তাদের নিয়ে আলোচনা করা হলো-আল মুকাদ্দাসি
আল মুকাদ্দাসি ছিলেন একজন বিখ্যাত মুসলিম পরিব্রাজক ও ভূগােলবিদ। তিনি স্পেন, ভারতবর্ষ ও সিজিস্তান ছাড়া প্রায় সমগ্র মুসলিম বিশ্ব ভ্রমণ করেছেন। দীর্ঘ বিশ বছরের ভ্রমণ অভিজ্ঞতার আলােকে তিনি 'আহসানুত-তাকাসিম ফি মারিফাতুল আকালিম' নামে ভূগােলবিষয়ক একটি বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেন।
আবুল হাসান আলি আল মাসউদি
আবুল হাসান আলি আল মাসউদি একাধারে পরিব্রাজক, ইতিহাসবিদ ও ভূগােলবিদ ছিলেন। তিনি 'মুরুজ আল যাহাব ওয়া মা'দিন আল-যাওয়াহির' নামে ঐতিহাসিক ভূগােল বিশ্বকোষ' রচনা করেন। এর মধ্যে তিনি তার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। তিনি পৃথিবীর আকার, আয়তন, গতি ও প্রধান প্রধান বিভাগগুলোর বিবরণ দেন। আল মাসউদি ভারত মহাসাগর, পারস্য সাগর ও আরব সাগরের ঝড়ের অবস্থার কথা উল্লেখ করেন এবং ভূকম্পন বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লেখেন। তিনি পৃথিবীর মানচিত্র অঙ্কন করেন।
মুসা আল খাওয়ারিযমি
মুসলিম ভূগােলবিদদের মধ্যে মুসা আল খাওয়ারিযমি এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি মিশরীয় ভূগোলবিদ টলেমির ভূগােলবিষয়ক গ্রন্থ আরবিতে অনুবাদ করে এর সাথে মানচিত্র সংযোজন করেন। তিনি পৃথিবীর পরিধিও নির্ধারণ করেন। আল খাওয়ারিযমি পৃথিবীকে 'সাতটি ভূখণ্ডে' বিভক্ত করেন এবং অন্যান্য ভূগোলবিদদের সহযােগিতায় সুরাতুল আরদ বা পৃথিবীর একটি প্রতিরূপ তৈরি করেন। তার সপ্ত ইকলিম থেকেই পরবর্তী ভুগোলবিদরা সাতটি মহাদেশের ধারণা লাভ করেন।
ইয়াকুত ইবনে আবদুল্লাহ আল হামাবি
পারস্যের মুসলিম মনীষী ইয়াকুত ইবনে আবদুল্লাহ আল হামাবিকে মুসলিম ভুগােল শাস্ত্রের জনক বলা হয়। তাঁর রচিত মুজামুল বুলদান নামক গ্রন্থটি ভুগোলশাস্ত্রের একটি প্রামাণ্যগ্রন্থ। এ গ্রন্থে তিনি আরব থেকে উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত এলাকার নগরসমূহের বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ তুলে ধরেন। এতে তিনি প্রত্যেক স্থানের ঐতিহাসিক, জাতিতান্ত্বিক ও প্রকৃতিক বিষয়ের বিবরণ দিয়েছেন। ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের পরিচয় ও ঘটনাসমূহের উল্লেখ করেছেন।
আল ইদ্রিস
মধ্যযুগের মুসলিম ভূগােলবিদ আল ইদ্রিস প্রাচীন ও আধুনিক ভৌগোলিক জ্ঞানের মধ্যে সমন্বয় সাধন করেন। ভূগােলবিষয়ক তার বিখ্যাত গ্রন্থ হলো 'কিতাবুল রোজারি'।
ইবনে খালদুন
তিউনিসিয়ার মুসলিম ভূগোলবিদ ইবনে খালদুন তার ভূগােলবিষয়ক 'আল মুকাদ্দিমা' গ্রন্থের জন্য বিশ্বব্যাপী খ্যাতিলাভ করেন।
ইবনে খুরদাদ
আরবের প্রধান বাণিজ্য পথ এবং চীন, জাপান ও কোরিয়ার ভৌগােলিক অবস্থান বর্ণনা করে ইবনে খুরদাদ লেখেন 'কিতাবুল মাসালিক ওয়াল মামালিক'।
ইবনে রুশতাহ
ইবনে রুশতাহ রচনা করেন 'আল আলাক আন নাফিসা' নামক ৭ খণ্ডে বিন্যস্ত ভূগােল বিশ্বকোষ।
আল-ইসতাখরি
আল-ইসতাখরি তার ভূগােলবিষয়ক গ্রন্থে রঙিন মানচিত্র ব্যবহার করেন। ইবনে-হাওকাল লেখেন ভ্রমণ কাহিনিনির্ভর ভূগোলগ্রন্থ।
আল-বিরুনী
আল-বিরুনী সর্বপ্রথম পৃথিবীর গােলাকার মানচিত্র তৈরি করেন। তিনি তাঁর 'কিতাবুল হিন্দ' গ্রন্থে ভূবিদ্যার ওপর আলােকপাত করেন। এতে তিনি নদীর ভূসংস্থান, ভূত্ত্ব, জোয়ারভাটা, মহাসমুদ্র, আবহাওয়া, ভূমি পরিমাপমূলক কাজ প্রভৃতি বিষয় আলােচনা করেন।
জ্যোতির্বিদ্যায় মুসলমানদের অবদান
জ্যোতির্বিদ্যা হলাে মহাকাশ সম্পর্কিত বিজ্ঞান। এটি গ্রহ, নক্ষত্র, চন্দ্র, সূর্য প্রভৃতির গতিপ্রকৃতি নিয়ে আলােচনা করে। মুসলমানগণই সর্বপ্রথম ইউরাপে জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কিত গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে তারা দূরবীক্ষণ যন্ত্র, দিক নির্ণয় যন্ত্র, দোলক ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করে জ্যোতির্বিজ্ঞানের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
মুসলিম মনীষীদের মধ্যে যারা জ্যোতির্বিদ্যায় বিশেষ অবদান রাখেন তাদের মধ্যে আল ফাজারি, মুসা আল খাওয়ারিযমি, আল নেহাওয়ান্দি, আল ফারাগানি, আবুল হাসান, আল বাত্তানী, আল বিরুনী, আব্দুর রহমান আস-সুফি ও ওমর খৈয়াম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নিচে তাদের নিয়ে আলোচনা করা হলো-
আল-বাত্তানী
মুসলিম জ্যোতির্বিদদের মধ্যে আল-বাত্তানীকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। তিনি জ্যোতির্বিদ্যা, ক্রিকোণমিতি ও গােলকীয় ত্রিকোণমিতির অনেক মৌলিক সূত্র আবিষ্কার করেন। দশম শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মুসলিম জ্যোতির্বিদ আল-বাত্তানী মিশরীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী টলেমির বহু মতবাদকে ভুল প্রমাণিত করায় তাকে মুসলিম টলেমি বলা হয়। তিনি সূর্যের গতি ও কক্ষপথ সম্পর্কে গভীর গবেষণা করেন। সূর্যের পরিভ্রমণে যে কোণ সৃষ্টি হয়, আল-বাত্তানী নির্ভুলভাবে তার মান নির্ণয় করেন। তিনিই সর্বপ্রথম প্রমাণ করেন, সূর্যের আপাতদৃষ্ট ব্যাসটি ধ্রুব নয়। শীতকালে সূর্যকে গ্রীষ্মকালের চেয়ে বড় মনে হয়। এ পার্থক্যের পরিমাণ ১৪২২০ ডিগ্রি চাপের একটি অর্ধবৃত্তাকারের সমান। তিনি নক্ষত্রের একটি তালিকাও প্রণয়ন করেন।
আল ফাজারি
খলিফা আল মনসুর এর সময় আল ফাজারি জ্যোতির্বিদ্যার ওপর রচিত সংস্কৃত 'সিদ্ধান্ত' গ্রন্থটির আরবি অনুবাদের মাধ্যমে জ্যোতির্বিজ্ঞান আলােচনার সূচনা করেন। 'আল-নেহাওয়ান্দী আল-মুশতামাল' নামে জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ে একটি নির্ঘন্ট প্রণয়ন করেন, যা গ্রিক ও হিন্দু উভয় জ্যোতির্বিদ্যার পথপ্রদর্শক হিসেবে স্বীকৃত। মুসলমানগণই সর্বপ্রথম ইউরােপে মানমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। আব্বাসীয় খলিফাগণ মানমন্দির প্রতিষ্ঠায় পৃষ্ঠপােষকতা দিলে মুসলিম জ্যোতির্বিদদের গবেষণায় ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়।
আবুল বাশার বালখি
আবুল বাশার বালখি জ্যোতির্বিদ্যার ওপর চারটি বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেন যা ল্যাটিন ভাষায় অনুদিত হয়। তিনি জোয়ারভাটা সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, পৃথিবীর উপর চন্দ্রের আকর্ষণই জোয়ারভাটার কারণ।
আবুল হাসান
আরেক মুসলিম জ্যোতির্বিদ আবুল হাসান টিউব দিয়ে একটি স্থুল টেলিস্কোপ তৈরি করেছিলেন। চাঁদের গতি নির্ধারণ ও পর্যবেক্ষণে তিনি বিশেষ অবদান রাখেন।
আব্দুর রহমান আস-সুফি
পর্যবেক্ষণমূলক জ্যোতির্বিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন আব্দুর রহমান আস-সুফি। তাঁর রচিত 'নক্ষত্রেরাজির গতি' গ্রন্থটি এ শাস্ত্রের অধ্যয়নে বিশেষ সহায়ক। ওমর খৈয়াম প্রথম বর্ষপঞ্জি তৈরি করেন।
মুসা আল খাওয়ারিযমি
মুসা আল খাওয়ারিযমি জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত একটি ছক তৈরি করেন। তিনিই বিশ্বমানচিত্রের প্রথম ধারণা দেন।
আল ফারাগানি
জ্যোতির্বিদ্যায় আল ফারাগানি 'Elements of Astronomy' নামে একটি প্রামাণ্যগ্রন্থ রচনা করেন।
মুসলিম জ্যোতির্বিদদের বড় কৃতিত্ব হলাে তারা এ শাস্ত্রের তাত্ত্বিক উন্নয়নের পাশাপাশি ব্যবহারিক উন্নতিও নিশ্চিত করেন এবং বিভিন্ন সাহায্যকারী যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করে জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেন।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান
চিকিৎসাবিজ্ঞানের আধুনিকায়ন এবং উদ্ভাবিত তত্ত্বসমূহের বাস্তব প্রয়ােগ করে মুসলিম চিকিৎসাবিজ্ঞানীগণ এ শাস্ত্রে অবিস্মরণীয় অবদান রাখেন। পৃথিবীর প্রাথমিক দিকে মানুষের মধ্যে চিকিৎসার ধারণা ততটা প্রবল ছিল না। কুরআন মজিদে মানুষের অসুস্থতা ও সেবা বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের পর মুসলিমগণ এ বিষয়ে সচেতন হতে শুরু করেন।
রাসুলুল্লাহ (স) তাঁর বাণীতে বিভিন্ন ভেষজ ও প্রাকৃতিক বিষয় দিয়ে চিকিৎসার নির্দেশনা দেন। পরবর্তীতে রাসুলের (স) চিকিৎসাবিষয়ক এ বাণীই মুসলিমদের পথপরিক্রমার পাথেয় হয়।
মুসলিম চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মধ্যে আবু বকর আল- রাযি, ইবনে সিনা, আল-যাহরাবি, হাসান ইবনে হায়সাম, আল-তাবারি, ইবনে আল-নাফিস, ইবনে আল-আব্বাস, ইবনে ঈসা, ইবনে রুশদ, আবুল কাসিম প্রমুখ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নিচে তাদের নিয়ে আলোচনা করা হলো:
আবু বকর আল-রাযি
খ্যাতনামা মুসলিম চিকিৎসাবিজ্ঞানী, রসায়নবিদ ও দার্শনিক আবু বকর আল-রাযি ৮৬৪ খ্রি. ইরানে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রায় ৩৫ বছর ইরানের রয়েল হাসপাতাল এবং বাগদাদের মুক্তাদারি হাসপাতালে চিকিৎসকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বিভিন্ন রোগের চিকিৎসাপদ্ধতি আবিষ্কার করেন এবং ওষুধ তৈরি করেন। আল-রাযি রােগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার পাশাপাশি তখনও পর্যন্ত ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি এমন রােগ নিয়েও গবেষণা করেন। তিনিই প্রথম বসন্ত ও হাম রোগের প্রকৃতি, সংক্রমণ ও নিরাময় নিয়ে গবেষণা করেন। এ বিষয়ে তার লেখা 'আল-জুদারী ওয়াল হাসবাহ' ছিল অত্যন্ত মৌলিক গ্রন্থ। এ গ্রন্থের আগে কোনো সভ্যতার লােকদেরই এ সম্পর্কে কোনাে ধারণা ছিল না। আল-রাযি মূত্রনালি ও কিডনির পাথর রোগ সম্পর্কেও প্রাথমিক আলোচনা করেন। তিনি সার্জারি বা শল্য চিকিৎসায় বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন। আল-রাযি হাম, শিশু চিকিৎসা, নিউরোসাইকিয়াট্রিক প্রভৃতি সম্পর্কে নতুন মতবাদ দেন। তিনিই শিশুরোগ ও এর চিকিৎসা সম্পর্কে প্রথম গ্রন্থ রচনা করেন। এজন্য আবু বকর আল-রাযিকে শিশু চিকিৎসার জনক (Father of Paediatrics) বলা হয়।
ইবনে সিনা
আবু আলী ইবনে সিনা হলেন আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক। তিনি আদিম পদ্ধতির চিকিৎসার পরিবর্তে আধুনিক পদ্ধতি চালু করেন। সেজন্য তাকে আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্র, চিকিৎসাপ্রণালি এবং শল্য চিকিৎসার দিশারী মনে করা হয়। ইবনে সিনা ওষুধ বিশেষজ্ঞ ছিলেন। ওষুধ তৈরি, সংরক্ষণ ও তা প্রয়ােগের আধুনিক পদ্ধতির উদ্ভাবক তিনি। এজন্য ইউরোপীয় চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা তাকে 'Master of Medicine' বলেছেন। ইবনে সিনা প্রাচীন গ্রিসের চিকিৎসাবিজ্ঞানী হিপােক্রেটিস (Hippocrates) ও গ্যালেনের (Galen) রেখে যাওয়া অসম্পূর্ণ চিকিৎসাশাস্ত্রের পূর্ণতা বিধান করেন। মধ্যযুগে যক্ষ্মা মহামারি আকার ধারণ করেছিল। ইবনে সিনাই প্রথম ব্যাপক গবেষণার মাধ্যমে সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, যক্ষ্মা একটি সংক্রামক ব্যাধি। মাটি ও পানির মাধ্যমে এটি বিস্তার লাভ করে। যক্ষ্মা বিষয়ে ইবনে সিনার গবেষণা ছিল অত্যন্ত আধুনিক। চিকিৎসাশাস্ত্রের ওপর ইবনে সিনা বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেন। এর মধ্যে শ্রেষ্ঠতম হচ্ছে 'কানুন ফিত তিব'। তিনি এ গ্রন্থে ৭৬০টি ওষুধের বর্ণনা এবং চিকিৎসাপদ্ধতি উল্লেখ করেছেন। ইবনে সিনা এটি ছাড়াও 'কিতাবুস শিফা' নামে ১৮ খণ্ডের একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেন। এতে তিনি বিভিন্ন রোগের উপসর্গ ও সেগুলাের নিরাময় পদ্ধতি সম্পর্কে বিবরণ দেন। কিতাবুল মুরাদ, কিতাবুল নাযাত, কিতাবুল কুলনজ ইবনে সিনার অন্যতম গ্রন্থ।
আল-যাহরাবি
আবুল কাসিম যাহরাবি স্পেনের সর্বশ্রেষ্ঠ শল্য চিকিৎসক (সার্জন)। শল্য চিকিৎসায় ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্র আবিষ্কার এবং সর্বসাধারণের কাছে চিকিৎসাশাস্ত্রকে সহজ পাঠ্যে পরিণত করা তার শ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব। তিনি দাঁত সাফ করা, মাড়ির গােশত কাটা, দাঁত তােলা, চোখের সানি অপসারণ, অন্ধত্ব দূরীকরণ, মৃত্রনালির পাথর অপসারণ, ভাঙা হাড় বের করা ও বাড়তি গােশত কেটে ফেলার যন্ত্র তৈরি করেন। তার বিখ্যাত বই 'আল-তাসরিফ লিমান আযিযা আন আল-তায়ালিফ' তাকে সাধারণ লােকদের প্রিয় চিকিৎসকে পরিণত করেছে।
হাসান ইবনে হায়সাম
হাসান ইবনে হায়সাম হলেন শ্রেষ্ঠ দৃষ্টিবিজ্ঞানী। চক্ষুচিকিৎসার প্রায় সব আধুনিক পদ্ধতিরই তিনি সফল প্রয়ােগকারী ছিলেন। তার গ্রন্থ 'কিতাবুল মানাযির' তাকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে।
আল-তাবারি
মুসলিম চিকিৎসাবিজ্ঞানী আল-তাবারি আরবি ভাষায় সর্বপ্রথম চিকিৎসাবিজ্ঞানের ওপর পূর্ণাঙ্গ প্রন্থ রচনা করেন। তিনি বিভিন্ন রােগের প্রকৃতি ও চিকিৎসাপদ্ধতি বিষয়ে কয়েকটি মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেন। এগুলাের মধ্যে ফিরদাউস আল-হিকমাহ ফিত-তিব বা চিকিৎসাবিজ্ঞানের স্বর্গ গ্রন্থটি সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। এটিকে চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রথম বিশ্বকোষ বলা হয়।
ইবনে নাফিস
ইবনে আল-নাফিস মানবদেহে রক্ত সঞ্চালন পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। যদিও এটি উইলিয়াম হার্ভে ও মিগুয়েল সার্ভেটাসের আবিষ্কার বলে চিহ্নিত হয়, কিন্তু প্রকৃত সত্য হলাে তাদের আবিষ্কারের প্রায় তিনশত বছর আগে ইবনে নাফিস এ আবিষ্কার সম্পন্ন করেন।
ইবনে আব্বাস
আলী ইবনে আব্বাস আল-মাজুসী স্মরণকালের অন্যতম মুসলিম চিকিৎসাবিজ্ঞানী। চিকিৎসাশাস্ত্রে তার শ্রেষ্ঠ অবদান কিতাব আল মালিকী। এ গ্রন্থে তিনি চিকিৎসা পদ্ধতির তাত্ত্বিক ও ব্যাবহারিক দিক নিয়ে আলােচনা করেন।
ইবনে ঈসা
আলী ইবনে ঈসা চক্ষুবিশেষজ্ঞ ছিলেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ওপর তার বত্রিশ খানা মূল্যবান গ্রন্থ রয়েছে। এর মধ্যে তাযকিরাত আল-কাহালিন অন্যতম।
ইবনে রুশদ
খ্যাতিমান দার্শনিক ইবনে রুশদ ব্যাবহারিক চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। তিনি বহু প্রতিষেধক ওষুধ আবিষ্কার করেন। 'আল-কুল্লিয়াত ফিত তিব' তার চিকিৎসাবিষয়ক গ্রন্থ।
আম্মার
শীর্ষস্থানীয় চক্ষুবিশেষজ্ঞদের মধ্যে আম্মার অন্যতম। এ বিষয়ে তিনি 'আল-মুনতাখাব ফি ইলাজ আল-আইন' নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এ গ্রন্থে আম্মার ১৩০ রকমের চক্ষু রােগ ও এগুলোর চিকিৎসা পদ্ধতি বিশ্লেষণ করেন।
বর্তমানে প্রচলিত জনপ্রিয় চিকিৎসা পদ্ধতির পাশাপাশি মুসলিম চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা ভেষজ চিকিৎসা শাস্ত্রের ওপরও কাজ করেন। তারা এ শাস্ত্রের আবিষ্কার, বিকাশ ও সমৃদ্ধির নেপথ্যে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ভেষজ পদ্ধতির ওপর মুসলিম চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা প্রথম গ্রন্থ রচনা করেন এবং এর আলােকে ওষুধ তৈরি ও বিপণনের জন্য সংস্থা গড়ে তােলেন। সর্বসাধারণের নিয়মতান্ত্রিক চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে মুসলিমরা প্রথম পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল গড়ে তালেন। খলিফা ওয়ালিদ এর নির্দেশে ৭০৭ খ্রিষ্টাব্দে সিরিয়ার দামেস্কে এ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়। এভাবে মুসলিম চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের অসাধারণ মেধা ও দক্ষতায় চিকিৎসাবিজ্ঞান শাস্ত্রগত উন্নতির পাশাপাশি ব্যাবহারিক ক্ষেত্রেও আধুনিক রূপ লাভ করে।
রসায়ন শাস্ত্রে মুসলমানদের অবদান
বিজ্ঞানের অন্যতম মৌলিক শাখা হলাে রসায়নশাস্ত্র।বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মতো রসায়নশাস্ত্রে ও মুসলিম মনীষীদের অসামান্য অবদান রয়েছে। মূলত রসায়ন শাস্ত্রের সূচণা হয়েছিল মুসলিম বিজ্ঞানীদের হাত ধরেই। প্রাচীনকালে মিশরের মুসলিম বিজ্ঞানীরা আল-কেমি বা রসায়নাগারে রসায়নের চর্চা করত। আরবি শব্দ আলকেমি থেকেই ক্যামিস্ট্রি শব্দটি এসেছে। এ থেকে বুঝা যায় মুসলিম বিজ্ঞানীরা রসায়নের স্রষ্টা। শুধু সৃষ্টিই নয় অনেক মুসলিম বিজ্ঞানীরা রসায়নকে সমৃদ্ধ ও করেছে। রসায়নে সাংকেতিক চিহ্নও প্রথম মুসলিমরা ব্যবহার করেন। মুসলিম রসায়নবিদদের মধ্যে জাবির ইবনে হাইয়ান, আল কিন্দি, জুননুন মিসরি ও ইবনে আবদুল মালিক আল-কাসি প্রমুখের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। নিচে রসায়ন শাস্ত্রে মুসলিম মনীষীদের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করা হল:
জাবির ইবনে হাইয়ান (৭২২-৮০৪ খ্রি.)
জাবির ইবনে হাইয়ান এর সম্পূর্ণ নাম হচ্ছে আবু মুসা জাবির ইবনে হাইয়ান, ইবনে আব্দুল্লাহ আল আজাদী, আত তুসি, আস সুফি, আল ওমাবি। তবে তিনি আবু মুসা জাবির ইবনে হাইয়ান নামেই অধিক পরিচিত। ইউরোপীয় পণ্ডিতদের কাছে তিনি 'জিবার (Geber)' নামে পরিচিত। রসায়নশাস্ত্রের ইতিহাসে জাবির ইবনে হাইয়ান এর নাম অতি পরিচিত। বর্তমান রসায়ন বিজ্ঞানের অধিষ্ঠান জাবির ইবনে হাইয়ান এর মৌলিক আবিষ্কার এর ওপরই। জাবির ইবনে হাইয়ান সর্বপ্রথম রসায়নকে বিজ্ঞানের একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। জাবির ইবনে হাইয়ান কে আলকেমি বা রসায়নশাস্ত্রের জনক বলা হয়। জাবির ইবনে হাইয়ান আরবের কুফায় একটি বিজ্ঞানাগার প্রতিষ্ঠা করে সেখানে তিনি বিভিন্ন রাসায়নিক গবেষণা পরিচালনা করতেন। জাবির ইবনে হাইয়ান বিভিন্ন রাসায়নিক প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করেন। তিনি রসায়নশাস্ত্রের অন্যতম প্রধান দুটি সূত্র ভস্মীকরণ (Calcination) ও লঘুকরণ (Reduction) এর বিজ্ঞানসম্মত আলােচনা করেন। তরল পদার্থকে বাষ্পে পরিণত করার এবং বাষ্পকে তরল পদার্থে পরিণত করার পদ্ধতি তার জানা ছিল। জাবির ইবনে হাইয়ান পাতন, উর্ধ্বপাতন, পরিস্রবণ, দ্রবণ, গলন প্রভৃতি রাসায়নিক পদ্ধতির ব্যাপক উন্নতিসাধন করেন। Oxidation বা ধাতুর সাথে অম্লজান মিশ্রণ এবং হিসাব নিরুপণের রাসায়নিক পদ্ধতি তার হাতেই পূর্ণতা পায়।
জাবির ইবনে হাইয়ানের বড় কৃতিত্ব হলো তিনি রাসায়নিক সূত্র ও পদ্ধতির ব্যবহারিক রূপ দেন। তিনি ধাতুর মানগত উন্নতিবিধান, স্টিল ও লােহা তৈরি, মারকাসাইট থেকে স্থায়ী লেখার কালি তৈরি, চামড়া ও কাপড় রং করা, কাপড়কে ওয়াটার প্রুফ করা ও লােহা সংরক্ষণের জন্য বার্নিস ব্যবহার করা, ম্যাঙ্গানিজ ডাই-অক্সাইড থেকে কাচ তৈরি করা, সােনালি অক্ষরে লেখার জন্য লৌহ পাইরিটসের ব্যবহার করা এবং এসিডের ঘনত্বের জন্য অম্লরস চোলাই করার পদ্ধতির সফল প্রয়ােগ করেন। সাইট্রিক এসিড, সিলভার নাইট্রেট, কিউপ্রিক ক্লোরাইড, এন্টিমনি, আর্সেনিক প্রভৃতি বিষয়ে তার প্রয়ােজনীয় জ্ঞান ছিল। জাবির ইবনে হাইয়ান লবণ তৈরির একটি সফল ব্যবহারিক পদ্ধতির উদ্ভাবন করেন। জাবির ইবনে হাইয়ান বিজ্ঞান বিষয়ে দু'হাজারের বেশি গ্রন্থ রচনা করেন। এর মধ্যে রসায়ন নিয়ে লেখা গ্রন্থের সংখ্যা হলাে ২৬৭টি। বর্তমানে তার রচনা সমগ্রকে কয়েকটি সংকলনে বিন্যস্ত করা হয়েছে। এ সংকলনের প্রত্যেকটিতে ৭০ থেকে ৫০০ পর্যন্ত গ্রন্থ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তার গ্রন্থগুলাের মধ্যে কিতাব আল-তাজমী, কিতাব আল-রাহমাহ, আল-শারাকী প্রভৃতি অন্যতম।
জুননুন মিসরি
তার অপর নাম ছাওবান। তিনি জুননুন মিসরি নামেই অধিক পরিচিত, আরবের মুসলমান বিজ্ঞানীদের মধ্যে রসায়নশাস্ত্রের উপর যাঁরা প্রথমদিকে গবেষণা করেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন জুননুন মিসরি। জুননুন মিসরি রসায়নশাস্ত্রের উপকরণ সম্পর্কে লেখালেখি এবং গবেষণা করেন। তার গবেষনা ও লেখার মধ্যে স্বর্ণ এবং রুপাসহ বিভিন্ন খনিজ পদার্থের বর্ণনা পাওয়া যায়। তিনি মিশরীয় সাংকেতিক বর্ণের মর্মার্থ বুঝতেন। জুননুন মিসরি মিশরের আল জিজাহ নামক স্থানে ৮৫৯ খ্রি. ইন্তিকাল করেন।
ইবনে আবদুল মালিক আল কাসি
ইবনে আবদুল মালিক আল কাসি রচিত 'আইনুস সানাহ ওয়া আইওয়ানুস সানাহ' (Essence of the Art and Aid of Worker) গ্রন্থটি রসায়নশাস্ত্রে একটি মূল্যবান সংযােজন। তিনি এ গ্রন্থে রসায়নের প্রত্যেক প্রয়ােজনীয় বিষয়ের সহজ-সরল পন্থা সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করেছেন।
গণিত শাস্ত্রে মুসলমানদের অবদান
বিজ্ঞানের মূল (Root) হলাে গণিতশাস্ত্র। এ শাস্ত্রের উৎপত্তি, বিকাশ ও উৎকর্ষসাধনে মুসলিম গণিতবিদগণ অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন। তারা মৌলিক গবেষণার মাধ্যমে গ্রিক জ্যামিতির জটিল সমস্যাগুলাের সমাধান করতে সক্ষম হন। মুসলিম গণিতবিদদের প্রচেষ্টায় ইউরােপে ভারতীয় শুন্যের (০) ধারণা প্রবর্তিত হয়। দশমিক প্রথা, বীজগণিত, গােলাকার ত্রিকোণমিতির প্রবর্তন প্রভৃতি গণিতে মুসলিমদের অবদানকে অমর করে রেখেছে। যেসব মুসলিম মনীষী গণিতশাস্ত্রের উদ্ভব ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে আল-খাওয়ারিযমি, আল-বিরুনি, আল বাত্তানি,নাসির উদ্দীন তুসি, ওমর খৈয়াম, আল তৈয়ব, মুহাম্মদ বিন ঈসা প্রমুখ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো-
ইবনে মুসা আল খোয়ারিজমি
মুসলিম মনীষীদের মধ্যে গণিতশাস্ত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখেন মুহাম্মাদ ইবনে মুসা আল-খাওয়ারিযমি। তাকে গণিতশাস্ত্রের বিশেষত বীজগণিতের জনক বলা হয়। বীজগণিতের ওপর লেখা তার অবিস্মরণীয় গ্রন্থটির নাম "হিসাব আল জাবর ওয়াল মুকাবেলা বা ইলমুল জাবর ওয়াল মুকাবেলা"। ইউরােপে গণিতজ্ঞদের কাছে এ আল-জাবরই Algebra (এলজেবরা)'য় পরিণত হয়। যেকোনাে বিবেচনাতেই 'হিসাব আল জাবর' বীজগণিতের প্রথম ও শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থ। এতে Quadratic equation বা দ্বিতীয় মাত্রার সমীকরণের সমাধান, বীজগাণিতিক গুণ ও ভাগ এবং আল-খাওয়ারিযমির নিজস্ব সূত্র ও সমস্যার সমাধান বিশ্লেষিত হয়েছে। গ্রন্থটিতে তিনি বিভিন্ন ধরনের গণিতের আট শতাধিক উদাহরণ উপস্থাপন করেন। ভারতীয় গণনা পদ্ধতি অনুসরণ করে আল-খাওয়ারিযমি শুদ্ধ গণিত (Arithmetic) বিষয়ে কিতাবুল হিন্দ' নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। সংখ্যার উৎপত্তির ওপর লেখা তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থটি হচ্ছে 'আল-জাম ওয়াত তাফরিক'। আল-খাওয়ারিযমি পরিমিতি হিসেবে ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, বৃত্ত, পিরামিড প্রভৃতির আয়তন ও পরিধি নিরূপণের প্রণালি নিয়ে বিস্তারিত আলােচনা করেছেন।
আল বাত্তানী (৮৫৮-৯২৯ খ্রি.)
আব্দুল্লাহ আল-বাত্তানী খ্রিষ্টীয় নবম-দশম শতকের শ্রেষ্ঠ গণিতবিদ। গণিতশাস্ত্রের ক্রমােন্নতিতে তিনি বিশেষ অবদান রাখেন। ত্রিকোনমিতির অনুপাত প্রকাশ আল-বাত্তানীর প্রধান কীর্তি। গণিতশাস্ত্র ইতিহাসে ক্রিকোণমিতিকে আল বাত্তানিই সম্পূর্ণ স্বাধীন, স্বতন্ত্র ও পূর্ণাঙ্গভাবে প্রথম তুলে ধরেন। ত্রিকোণমিতির Sine, Cosine, Tangent, Cotangent ইত্যাদি সাংকেতিক নিয়মের তাৎপর্যপূর্ণ ব্যবহার তিনিই প্রথম করেন। এসব সংকেতের মধ্যে বিভিন্ন সম্পর্ক তিনি আবিষ্কার করেন। কোনাে কোণের সাইন জানা থাকলে তার ট্যানজেন্ট বের করা এবং ট্যানজেন্ট জানা থাকলে তার সাইন বের করার নিয়ম তিনিই উদ্ভাবন করেন।
নাসিরুদ্দীন তুসী (১২০১-১২৭৪ খ্রি.)
মুসলিমদের গণিত চর্চায় মুহাম্মদ নাসির উদ্দিন তুসি একটি উজ্জ্বল নাম। তিনি ত্রিকোণমিতি, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিজ্ঞান প্রভৃতি শাস্ত্র সম্পর্কে ১৬টি গ্রন্থ রচনা করেন। ত্রিকোণমিতিকে জ্যোতির্বিজ্ঞান থেকে পৃথক করে এবং সমতল ও গােলাকার ত্রিকোণমিতি সম্পর্কে আলােচনা করে তিনি বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন।
আল-মাহানি ও আল-সারাকশি
আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ বিন ঈসা আল-মাহানি ছিলেন পারস্যের বিখ্যাত গণিতবিদ। তিনি জ্যামিতি, ঘনসমিকরণ ও ত্রিকোণমিতি সম্পর্কে গ্রন্থ রচনা করেন এবং আল খাওয়ারিযমির উদ্ভাবিত ও প্রতিষ্ঠিত বীজগণিতের আধুনিকায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। মুহাম্মদ বিন তৈয়ব আল-সারাকশি ত্রিকোণমিতির ওপর প্রথম পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রচনা করে বিশেষ খ্যাতিলাভ করেন।
আল-বিরুনি (৯৭৩-১০৪৮ খ্রি.)
আল-খাওয়ারিযমির পরে দ্বিতীয় সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলিম গণিতবিদ হলেন আল-বিরনি। গণিতে তার শ্রেষ্ঠতম অবদান 'আল-কানুন আল-মাসউদী। এটিকে গণিতশাস্ত্রের বিশ্বকোষ বলা হয়। আল বিরুনি তার এ গ্রন্থটিতে জ্যামিতি, ত্রিকোণমিতি, ক্যালকুলাস প্রভৃতি বিষয়ের সূক্ষ্ম, জটিল ও গাণিতিক সমস্যার বিজ্ঞানসম্মত আলােচনা করেন। এ গ্রন্থে তিনি পরিমাপ পদ্ধতির ওপর কাজ করেন। আর পৃথিবীর পরিমাপ সম্পর্কে অদ্যাবধি স্বীকৃত এবং বৈজ্ঞানিক সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত একটি পরিমাণ উপস্থাপন করেন।
ওমর খৈয়াম (১০১৯-১১৩৫ খ্রি.)
গণিতশাস্ত্রে মুসলিম মনীষীদের মধ্যে ওমর খৈয়াম সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। ঘন সমীকরণ ও অন্যান্য উন্নততর সমীকরণের পদ্ধতিগত বিশ্লেষণ এবং সংজ্ঞানুসারে এগুলোর শ্রেণিবিন্যাস করে ওমর খৈয়াম বীজগণিতের উন্নতি সাধনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। পাটিগণিত ও জ্যামিতির ওপরও তিনি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন। ওমর খৈয়াম গণিত বিষয়ে ২২টি মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেন। 'কিতাবুল জিবার' তার সর্বশ্রেষ্ঠ গণিত গ্রন্থ। এতে তিনি গণিতের সর্বজনীন সংজ্ঞা নিরূপণ করেন এবং দ্বিপদী, ক্রিপদী ও চতুর্পদী সমীকরণের শ্রেণিভেদ ও বিশ্লেষণের অসাধারণ দক্ষতা প্রদর্শন করেন। গণিতে তার সবচেয়ে মৌলিক অবদান হলাে জ্যামিতিক পদ্ধতিতে ত্রিঘাত সমীকরণের (Cubic equation) সমাধান করা। তিনিই প্রথম বীজগণিতের ভগ্নাংশীয় সমীকরণ সম্বন্ধে আলােচনা করেন। মুশকিলাত-ই-হিসাব তার অপর একটি বিখ্যাত গ্রন্থ।
এছাড়া আবুল ওয়াফার, জাবির বিন আফলাহ, আল-কালাহাদি, আল-কিন্দি, আল-ফারাবি, আল-ইয়ামি প্রমুখ মুসলিম মনীষীও গণিতশাস্ত্রের উন্নয়নে অবিস্মরণীয় অবদান রাখেন।
তথ্যসুত্র : বই - ইসলাম শিক্ষা।
লেখক: ড. এ আর এম আলী হায়দার।